Tuesday, July 10, 2012

সত্যমেব জয়তে, আমির খান এবং ভারতীয় সমাজ

টেলিভিশনের জন্মের পর থেকেই এই মাধ্যমকে অনেকেই বোকা বাক্স হিসেবে মনে করেন। আর আজকের দিনে, যখন ভারতে ছ'শোর বেশী চ্যানেল সম্প্রচারিত হচ্ছে, তখন এই বিশেষণকে খুব একটা ভুলও বলা যায় না, বিশেষতঃ বেশীর ভাগ চ্যানেলেই শ্বাশুড়ি-বৌমা, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি নিয়ে যখন একের পর এক সিরিয়াল বা "মেগা" চলতেই থাকে। সংবাদ পরিবেশনকারী চ্যানেলগুলোও টিআরপি (জনপ্রিয়তার মাপকাঠি) বাড়ানোর চক্করে একের পর এক "ব্রেকিং নিউজ" বানাতেই থাকে। এর ফলটা এই হয় যে, যেকোন ঘটনাকেই চ্যানেলের মাধ্যমে sensationalize করে জনগণকে খাইয়ে দেওয়া হয়, আর দর্শকরাও নিউজস্টোরিকে বিনোদনের এক অংশ বলেই মনে করেন।

এরকম একটা অবস্থায় হঠাৎ শুনতে পাওয়া গেলো যে আমির খানও নাকি ছোট পর্দায় আসছেন। ব্যাস, সাথেসাথেই হইচই আরম্ভ হয়ে গেলো। মিডিয়ার লোকেরা নিত্যনতুন খবর দিতে আরম্ভ করলেন এই সিরিয়াল নিয়ে। কিছুদিন পরে জানা গেলো যে সিরিয়ালটার নাম "সত্যমেব জয়তে", অর্থাৎ সত্যের জয় সর্বত্র। বলা হলো যে এটা একটা "রিয়ালিটি শো", অর্থাৎ বাস্তবিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে প্রস্তুত। আর এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ভারতের সমাজ ব্যবস্থায় এবং ভারতীয়দের রোজকার জীবনে চলতে থাকা সামাজিক ব্যাধিগুলোকে নির্মূল করা।

সত্যমেব জয়তের সাথে যেহেতু আমির খান যুক্ত, তাই অনেকেরই আশা ছিলো যে এটা কোন গিমিক বা শস্তা প্রচারের লোভে করা অনুষ্ঠান হবে না। সত্যমেব জয়তে, সত্যি সত্যিই ভারতীয় সমাজে একটা পজিটিভ বদল আনবে বলে মনে করা হচ্ছিলো। প্রথম দিকের এপিসোডগুলোর জনপ্রিয়তা দেখে ও অনুষ্ঠানের ফলে অনেক রাজ্য সরকারও নড়েচড়ে বসায় এই আশা আরো উজ্জ্বল হয়। কিন্তু পরবর্তীতে অনুষ্ঠান তার জনপ্রিয়তা আর ধরে রাখতে পারে নি। তবুও, এই অনুষ্ঠানের ফলে অনেকগুলো সামাজিক ব্যাধি এবং বে-আইনি কার্য্যকলাপের কথা সমাজ ও সাধারণ লোকের চোখের সামনে এসে পড়ে। আমির খান, তার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে সমাজের একদম সাধারণ শ্রেণীর লোকেদের মধ্যেও যেভাবে এই সামাজিক ক্ষতগুলোকে তুলে ধরেছেন, সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়।
অনুষ্ঠানের প্রথম থেকেই আমির এবং তার টিম যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রত্যেকটা বিষয়ের ওপর রিসার্চ করেছেন। সবকটা এপিসোদের পেছনেই তাদের পরিশ্রম, সৎ প্রচেষ্টা, দায়িত্বশীল মনোভাব - এগুলো ফুটে উঠেছে। প্রত্যেকটা বিষয়েই তারা যতটুক সম্ভব গভীরে যেতে চেষ্টা করেছেন। আর এই মনোভাবের ফলেই এমন অনেক বিষয়কে সত্যমেব জয়তের মাধ্যমে সাধারণ লোকের সামনে তুলে ধরা হয়েছে যেগুলো সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল থাকলেও কখনই সেগুলোর বিরুদ্ধাচরণ করি না।

যেমন ধরুন শিশুদের ওপর যে যৌন অত্যাচার করা হয়, তা আমরা অনেকেই জানি। ভারতে যে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে এক বিরাট সংখ্যক শিশু এই অত্যাচারের শিকার হয়, সেই স্ট্যাটিসটিকসও আমাদের নখদর্পণে। কিন্তু বেশীর ভাগ মা-বাবাই এই ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যেতে চান, চোখ বুজে না দেখার ভান করে থাকতে চান। বাবা-মার যে তাদের সন্তানের ওপর ভরসা করা উচিত এবং যাদের বিরুদ্ধে শিশু অভিযোগ জানিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, সেটা কিন্তু এই শোতেই প্রথম জোরালোভাবে বলা হয়েছে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটা হল ভারতে ছেলেদের ওপর যৌন অত্যাচার। শিশু অবস্থায় ছেলেদের এক বিশাল অংশই অত্যাচারিত হয়। কিন্তু মেয়েদের ব্যাপারে যাওবা অভিযোগ করলে অভিভাবকেরা সতর্ক হন, ছেলেদের অভিযোগকে সিরিয়াসলি নেওয়াই হয় না।

কণ্যাভ্রূণ হত্যা ভারতে, বিশেষতঃ উত্তর ভারতের একটা জ্বলন্ত সমস্যা। নির্বিচারে কণ্যাভ্রূণ হত্যা করার ফলে ভারতের বেশ কয়েকটা রাজ্যের স্ত্রী-পুরুষের অনুপাত প্রচণ্ডভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে খারাপ রাজ্যগুলোর মধ্যে হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশের কিছু অংশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশের অংশ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এই রাজ্যগুলোতে একশ্রেণীর অসাধু ডাক্তার এবং টেস্টিং ল্যাবরেটরির মালিকেরা সরকারী আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে লিঙ্গনির্ণয়ের পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। এই ব্যবসার সাথে অনেক টাকাও খাটে। তাই জানা থাকা সত্বেও এসব চক্রের বিরুদ্ধে বিশেষ কিছুই করে ওঠা যায় নি। সত্যমেব জয়তের সাফল্যটা এখানেই। প্রোগ্রাম দেখানোর দুদিনের মধ্যেই বেশ কিছু রাজ্যের সরকার ঐসব ক্লিনিক এবং ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করে। এই কড়াকড়ি কতদিন চলবে, সেটার ওপরই কিন্তু পুরো ব্যাপারটা নির্ভর করে। কয়েকদিন বা মাস পর যদি আবারও নজরদারির ব্যবস্থা শিথিল হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু কণ্যাভ্রূণ হত্যা আবারো ফিরে আসবে।

আরো একটা দৃষ্টান্ত হলো ডাক্তারদের স্বেচ্ছাচারিতা। অদ্ভুতভাবে, অন্যান্যক্ষেত্রের যেকোনও লোকের সততার মাপকাঠি, আর ডাক্তারদের ক্ষেত্রে সততার মাপকাঠির মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। আজকাল বেশীর ভাগ ডাক্তারই ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, এমনকি টাকাও নিয়ে শুধু সেই কোম্পানির ওষুধই নিজের রোগীদের জন্য লেখেন। এছাড়াও বিভিন্ন উপহার, পরিবারের সাথে বিদেশ ভ্রমণ ইত্যাদি সুবিধেও কোম্পানিগুলো দিয়ে থাকে। এর প্রতিদানে ডাক্তারও সেইসব কোম্পানির ওষুধের বিক্রী বাড়াতে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করেন। একইভাবে ডাক্তারদের সাথে পরীক্ষাগারগুলোরও যোগসাজস থাকে এবং ডাক্তারের পাঠানো রোগীর কাছ থেকে পাওয়া টাকার একটা ভালো অংশ (সাধারণতঃ ২৫% থেকে ৩০%) ক্লিনিকগুলো ডাক্তারকে কমিশন হিসেবে দেয়। কমিশনের টাকা বা ওষুধ কোম্পানির টাকা যেহেতু কালোটাকারই রকমফের, তাই এই টাকার লেনদেন প্রমাণ করতে পারাটাও যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু এই লেনদেনের নেট ফলটা দাঁড়ায় যে নিজেদের লাভের অঙ্ক বাড়ানোর জন্য ডাক্তাররা অনেক সময়ই অনেক অদরকারী ওষুধ খেতে দেন এবং হাবিজাবি টেস্ট করে আনতে বলেন। আমরা সবাই মোটামুটিভাবে এসব জানি। কিন্তু যেহেতু ডাক্তারদের ওপর আমাদেরকে নির্ভর করতে হয়, তাই আমরা এসব বিষয়কে দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাই, যদি ডাক্তারবাবু কিছু মনে করেন, যদি চিকিৎসাটা ঠিকমত না করেন - এইসব ভয়ে। সত্যমেব জয়তের টিম কিন্তু ডাক্তারদের তরফ থেকে বিরোধীতা আসবে জেনেও এই অশুভ আঁতাতকে প্রাইম-টাইমে সবার সামনে তুলে ধরেন। এরপর ডাক্তারদের বিভিন্ন সংগঠন আইনি হুমকি দেওয়া সত্বেও নির্মাতা, নির্দেশক এবং আমির খান-রা কিন্তু পিছিয়ে যান নি। তারা ডাক্তারদের হুমকির মোকাবিলা যথেষ্ট শক্ত হাতে করেছেন। এবং ডাক্তারদের একটা অংশও অভিযোগগুলো সত্য বলেই জানিয়ে দেওয়ায় মেডিক্যাল কাউন্সিল আর উচ্চ বা নীচ কোন রকমের বাচ্যই করে নি। এমনকি লোকসভা এবং রাজ্যসভার সাংসদরাও আমিরকে ডেকে তার বক্তব্য শুনতে চান।

এগুলো ছাড়াও আমির সত্যমেব জয়তের মাধ্যমে অনেকগুলো খুবই জ্বলন্ত সমস্যাকে সবার সামনে তুলে ধরেছেন। তাতে যেমন খাপ পঞ্চায়েত নামক নরপশুদের কথা বলা হয়েছে, তেমনি যথেচ্ছ কীটনাশকের ব্যবহার সম্পর্কেও সমাজকে সচেতন করা হয়েছে। বিভিন্ন এপিসোডে পণপ্রথার বিরোধীতা, অস্পৃশ্যতার বিরোধীতা, মাদক বা মদ খেয়ে রাস্তায় দুর্ঘটনার বিরোধীতা ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছে। আর এমনভাবে এটা করা হয়েছে, যে কোন পক্ষই এর বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনতে পারবেন না। সবচেয়ে যেটা ভালো লেগেছে, সেটা হলো এই প্রোগামের পেছনে করা রিসার্চ। প্রত্যেকটা এপিসোডেই এই পরিশ্রমের ফলটা দেখা যাচ্ছে।

এবার অনুষ্ঠান এখনও পর্যন্ত সফল হওয়ায় দেখতে পাচ্ছি, যে এক শ্রেণীর লোক বলছেন এই প্রোগ্রাম আসলে একটা গিমিক ছাড়া আর কিছুই নয়। এভাবে টেলিভিশনে প্রোগ্রাম দেখিয়ে কোন বিপ্লব আনা যায় না। সত্যমেব জয়তের মূল উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, জনগণ যেটা "খাবে" সেটাকেই সুন্দরভাবে প্যাকেজ করে ড্রয়িংরুমের ভেতরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এর পেছনে সেই আদি ও অকৃত্রিম টি আর পি-র খেলা, আর স্পনসরশিপের টাকা। কোন সামাজিক পট বদলের পালা খুঁজতে গেলে আপনাকে নিরাশ হতে হবে।

তা এরা কেনো প্রোগ্রামটাকে লঘু করে দেখিয়ে এবং বিরোধীতা করে ইস্যুগুলোকে ধামাচাপা দিতে চাইছেন, সেটা বোঝার জন্য রকেট সাইন্টিস্ট হবার কোন দরকার নেই। এরা বিরোধীতা করছে, কারন এদের স্বার্থে ঘা পড়েছে, আর মৌরসী-পাট্টা হাতছাড়া হয়ে যাবার ভয়ও আছে।

হ্যাঁ, এটা সত্যি কথা যে টেলিভিশনের প্রোগ্রামের মাধ্যমে হয়তো সামাজিক বিপ্লব আনা সম্ভব নয়। কিন্তু এই যে সবাই দেখতে পেল যে খাপ পঞ্চায়েতের দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রধানেরা আসলে মন্দবুদ্ধির কিছু লোক, যারা আইনের শাসনে বিশ্বাস করে না। এটার দামও কি কম? অন্ততঃ এদের যে সবকিছুর উর্দ্ধে বলে একটা ইমেজ আছে, সেটা তো ভাঙ্গলো! সত্যমেব জয়তে হয়তো, হয়তো কেন, নিশ্চিতভাবেই কোন সামাজিক পট বদল করতেও চাইছে না, আর এই বদলানো এক দিনের বা এক মাসের বা বছরের কাজও নয়। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে সাধারণ জনতার সামনে এরকম কু-প্রথা, সামাজিক ক্ষত বা সমাজের অসুখের কথা তুলে ধরা হচ্ছে। লোকেরা আরো বেশী সচেতন হবেন, এটাই এই প্রোগ্রামের লক্ষ্য। তার সাথে বিভিন কর্পোরেট সংস্থা, যেমন রিলায়েন্স ধিরুভাই আম্বানি ফাউণ্ডেশন, এয়ারটেল - এদের মাধ্যমে বিভিন্ন সমাজসেবী সংস্থার জন্য ফাণ্ড সংগ্রহ করা, যেটাতে এখনো পর্যন্ত টিম সত্যমেব জয়তে যথেষ্ট সফল।

আবারো বলছি, এই প্রোগ্রাম রাতারাতি সামাজিক বিপ্লব আনবে না, কিন্তু এর মাধ্যমে একটা সচেতনতা তো তৈরী হচ্ছে! এই সচেতন জনতা যদি সামাজিক ব্যাধিগুলোর বিপক্ষে কাজ করে যেতে থাকেন, তাহলেই ভারতের সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতে পারে। এখানে সত্যমেব জয়তের ভূমিকা অনেকটা অণুঘটকের। লোকেরা লেগে থাকলেই সমাজবিরোধীদের মধ্যেও পরিবর্তন আসাটা অবশ্যম্ভাবী।

No comments:

Post a Comment

Share