Friday, June 29, 2012

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক আর কতো তলিয়ে যাবে?

জকে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে তিন-চারটে খবর দেখতে পেলাম। কোনওটাই ভালো খবর নয়। এবং সবকটা খবরকে এক সাথে মিলিয়ে দেখলে যে ছবিটা ভেসে ওঠে, সেটা যথেষ্ট পরিমাণে চিন্তার উদ্রেককারী।
ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক
এক, গাইঘাটায় এক স্কুলের শিক্ষিকা ক্লাস সেভেনের এক ছাত্রী লেগিংস পরে স্কুলে এসেছিলো বলে তাকে শাস্তি দিলেন। কিভাবে? এক কো-এডুকেশন স্কুলে, ঘরভর্তি ছাত্র এবং ছাত্রীদের সামনে, তিনি মেয়েটির লেগিংস খুলে নিজের কাছে রেখে দিলেন। এরপর, ছাত্রী এবং তার বাবার অভিযোগ অনুযায়ী, মেয়েটি ঐ অবস্থায়ই বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয় এবং বাড়ি পৌঁছেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এরপর যথারীতি টিভি চ্যানেল ওখানে পৌঁছে যায় এবং ব্রেকিং নিউজ দিতে থাকে। শিক্ষিকার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে?
স্কুলে ছাত্রছাত্রী নির্যাতন
দুই, কলকাতার নামী স্কুল সাউথ পয়েন্টের ঘটনা। সহপাঠীদের হাতে মার খেয়ে ক্লাস ওয়ানের বাচ্চা ছেলে স্কুলের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্কুল কর্তৃপক্ষ কি করলেন? কিসসু না! ছেলেটার মা-বাবাকেও খবর দেওয়াটা দরকারী বলে ওরা মনে করেন নি। বাচ্চা ছেলেটা বাড়ি পৌঁছোনোর পর তার বাবা-মা সবকিছু জানতে পান এবং শেষে তারা গড়িয়াহাট থানায় একটা এফ আই আর দায়ের করেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ এতোটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হন কিভাবে?
শিক্ষক উপরে হামলা
তিন, আরামবাগের কাছাকাছি একটা জায়গায় টুকতে বাধা দেওয়ায় পরীক্ষার্থী ছাত্রের হাতে প্রহৃত হলেন শিক্ষক। তিনি অভিযুক্ত ছাত্রের বিরুদ্ধে এফ আই আর দায়ের করেছেন। এখানে দেখার বিষয়, ছাত্রের আদৌ কোনও শাস্তি হয় কি না!
তিনটা ঘটনাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থা একেবারেই বেহাল হয়ে পড়েছে। ছাত্র এবং শিক্ষকের মধ্যে যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার একটা সম্পর্ক ছিল, সেটার ছিটেফোঁটাও আজকের দিনে বোধহয় আর নেই। তাই একদিকে আমরা দেখতে পাই যে নামিদামী স্কুল, যেমন লা মার্টিনেয়ার বা সাউথ পয়েন্ট থেকে শুরু করে পাড়াগাঁয়ের স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হাতে অত্যাচারিত হচ্ছে, অথবা সবার সামনে হেনস্তা হয়ে হয়তো নিজের জীবনই শেষ করে দিচ্ছে। এর ফলে সমাজে বা শিক্ষকসমাজে যে কোন পরিবর্তন এসেছে, তাও বলা যাবে না। কারন কদিন পরপরই আরো এক নতুন রৌভনজিত বা গাইঘাটার দুর্ভাগা মেয়েটা, অন্য কোথাও, অন্য নামে, একইভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে। অন্যদিকে অনেক স্কুল শিক্ষক বা কলেজের লেকচারার-প্রফেসাররা স্কুল-কলেজের ভেতরেই হেনস্তা হচ্ছেন, কোথাওবা শারীরিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন এবং হাতেগোনা কয়েকটি ক্ষেত্রে জীবন বিসর্জনও দিয়েছেন।
শোভন চক্রবর্তী
এর শেষ কোথায়? আমি নিঃসন্দেহ, যে এই অবস্থায় শিক্ষার মান উন্নয়ণ নিয়ে কথা বলে, বা বড়োসড়ো সেমিনার করে, শ্বেতপত্র আর এ্যাকশন প্ল্যান প্রকাশ করে কিচ্ছুটি হবে না। হবার কথাও নয়। যতদিন এই পারস্পরিক অবিশ্বাস, ঘৃণা এবং অবমাননার প্রবাহ চলবে, ততোদিন কপিল সিবাল যাই বলুন না কেনো, শিক্ষাব্যবস্থার মান নীচের দিকেই যেতে থাকবে।
শিক্ষাব্যবস্থার মানের পতন
আরো যেটা দরকার, সেটা হলো শিক্ষারজগতে গুণ্ডামির প্রতি জিরো-টলারেন্স নীতি। এই গুণ্ডামি ছাত্র, শিক্ষক বা অশিক্ষক কর্মচারী, যারই শুরু করা হোক না কেনো, তার বা তাদের বিরুদ্ধে শক্তভাবে এবং কম সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে পারলে এই পারস্পরিক অশ্রদ্ধার অন্ততঃ বহির্প্রকাশটা বন্ধ হবে।
ছাত্রীর লেগিংগস সবার সামনে খুলে দেওয়া
যেমন, গাইঘাটার সেই শিক্ষিকার কথাই ধরুন। টিভিতে যতটুকু দেখলাম, তাতে মনে হলো যে সেই (অ)ভদ্রমহিলা সবার কাছে মাপ চেয়ে এবং মুচলেকা দিয়েই ছাড়ান পেয়ে গেছেন। কিন্তু এনার বিরুদ্ধে নন-বেলেবল পুলিশ কেস করে, গ্রেপ্তার করা উচিত ছিলো। আর সাথে সাথেই মহিলাটিকে সাসপেণ্ড করে, চাকরী থেকে বরখাস্ত করার প্রক্রিয়াও আরম্ভ করা উচিত ছিলো।
ছাত্র মার খেয়ে অসুস্থ
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, সাউথ পয়েন্টের প্রিন্সিপাল এবং পরিচালন সমিতির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও যথাসম্ভব শক্তপোক্ত কেস দেওয়া উচিত। আর এরকম ঘটনা ঘটালে, সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের সবরকমের স্কুল পরিচালনা থেকে বিরত করার জন্য একটা আইন করা উচিত।
ছাত্রীর কাপড় খুলে দেওয়া
তৃতীয় ক্ষেত্রে, পুলিশ কি করেছে সেটা চ্যানেলগুলো খুব বেশী জানায় নি। কিন্তু এরকম ছাত্রদের সোজাসুজি রাস্টিকেট করে দেওয়ার নিয়ম করা উচিত।
শিক্ষা তুমি কার
এছাড়াও আমার কাছে একটা ব্যাপার খুবই অদ্ভুত মনে হয়। প্রাথমিক স্তরে এবং মাধ্যমিক স্তরে যখন শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ করা হয়, তখন তাদের কিন্তু কোন সাইকো-এ্যানালিটিকাল টেস্ট করা হয় না। অথচ, আমরা সবাই খুব ভালোভাবেই জানি যে স্কুলের পড়াশুনোর ওপরেই পরবর্তীকালের শিক্ষার কতটা একজন ছাত্র বা ছাত্রী আয়ত্ব করতে পারবে, সেটা নির্ভর করে। আর বাচ্চাদের শেখানোর জন্য যে মানসিক প্রস্তুতির দরকার হয়, সেটা ক'জন শিক্ষক-শিক্ষিকার আছে, তা এদেরকে নিযুক্তি দেওয়ার আগেই ভালোভাবে দেখে এবং মেপে নেওয়া উচিত। এতে অন্ততঃ বিকৃতমনা লোকেরা শিক্ষক বা শিক্ষিকার পদের চাকরীতে ঢোকার রাস্তাটা বন্ধ করা যাবে।
ছাত্র শিক্ষক রাজনীতি
মানছি যে এর কোনটাই ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক সম্বন্ধকে উন্নত করবে না। কিন্তু এর একটা সুফল হবে যে কোন পক্ষই অপর পক্ষের বিরুদ্ধে চট করে কোন নির্যাতন করার সাহস পাবে না। আজকের দিনে শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানে যে এরকম কাণ্ডকারখানা করেও তাদের চাকরী যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। আর ছাত্র-ছাত্রীরাও জানে, যে শিক্ষককে দৈহিক নির্যাতন করেও রাজনৈতিক দলের মদতে তারা ছাড় পেয়ে যাবে। এই জানাটাই উভয় পক্ষেরই ভয়ডরটাকে কমিয়ে দেয় এবং তার পরিণাম আমাদের সামনে।

No comments:

Post a Comment

Share